এক.
ঘটনাটা পরিচিত একজনের। কোনো এক কারণে তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে তিনি সেদিন অফিস থেকে ফিরছেন। মাথা এমন ভার—যেন মস্তিষ্কের নিউরনগুলোতে জট বেঁধে গেছে।
এমন অস্বাভাবিক রাগ তার হয় না সাধারণত। কেন যে সেদিন তিনি এত রেগে গেলেন এবং মেজাজখানা-ই বা কেন একেবারে সপ্তমে চড়ে বসেছিলো কে জানে! বাসায় ফেরার জন্য একজন রিকশাওয়ালাকে বললেন,
‘অমুক জায়গায় যাবেন?
‘যামু।'
‘কত টাকা ভাড়া?
‘এত দেওন লাগব। রাস্তায় জ্যাম বেশি।
প্রথমত অসহ্য গরম, তার ওপর মস্তিষ্কের কোষগুলোতে তখন ঢাক-ঢোল পিটিয়ে যুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করেছে; খুব বেশি বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে ভাড়াটাকে যে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনবেন, মনের সেই অবস্থা নেই। একপ্রকার সওয়াল জওয়াব ছাড়াই রিকশায় চড়ে রাস্তার বাড়ি-ঘর, মানুষ আর যানবাহন গুনতে গুনতে বাসার উদ্দেশে পথ পাড়ি দিতে লাগলেন তিনি।
রিকশাওয়ালাকে যে জায়গার কথা বলে রিকশায় চড়েছেন, তার মূল সড়কে এনে রিকশাওয়ালা বললেন, ‘নামেন। আইয়্যা পড়ছি।
যদিও মাথার তেজ কমার বিন্দুমাত্র লক্ষণ নেই, তথাপি নিজেকে শান্ত রাখার সবটুকু চেষ্টা চেহারায় ফুটিয়ে তুলে এবং গলাটাকে যতখানি নরম করা যায়, তার সবটুকু ঢেলে দিয়ে বললেন, ‘এই দিকে একটু ভেতরে যান। সামনের মোড় পার হলেই আমার বাসা।
কিন্তু তার ভদ্র-কথা আর ভদ্রোচিত চেহারা—কোনোটাই রিকশাওয়ালার মন গলাতে পারলো না। তার আবদারকে সম্পূর্ণভাবে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে রিকশাওয়ালা বললেন, যেখানের কথা কইছেন ওইখানে আইয়্যা পড়ছি। এর বেশি আমি আর যাইতে পারুম না।'
অন্যকোনো দিন হলে একটা ব্যাপার ছিলো, কিন্তু সেদিন নিজের মন-মেজাজের বেহাল দশা, তার ওপর এখন আবার সামান্য একটা বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি! দেড় মিনিটের রাস্তা, একটুখানি সামনে গেলে কী এমন ক্ষতি হবে রিকশাওয়ালার?
তখনো নিজেকে স্বাভাবিক রাখার সবটুকু কসরত করে তিনি বললেন, দেখুন ভাই, আমি এই জায়গায় নামবো বলেছি ঠিক আছে, কিন্তু তার মানে তো এই না যে, আপনি আমাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে চলে যাবেন। আর এই এলাকা মানে তো কেবল এই রাস্তাটাই নয়। এলাকাটা বিশাল। রাস্তায় নেমে যাওয়ার জন্য তো আমি আপনার রিকশায় উঠিনি।
তিনি ভেবেছিলেন তার যুক্তিতে রিকশাওয়ালা একেবারে কুপোকাত হয়ে যাবেন, কিন্তু তাকে নিরাশ করে দিয়ে রিকশাওয়ালা বললেন,
“এত কথা কইয়েন না মামা। যে জাইগার নাম কইছেন ওই জাইগাই আইছি। অহন নামেন আর ভাড়া দেন।'
'না।'
‘আমাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে যাবেন?'
“তার মানে আপনি আর সামনে যাবেন না?
যেখানে কইছেন ওইখানে নামাই দিছি।'
নিজেকে আর ধরে রাখা গেলো না কোনোভাবে। সারাদিনের ক্লান্তি, মস্তিষ্কের ওপর মেজাজের যে ভারিক্কি চাপ পড়েছে সেটা এবং রিকশাওয়ালার অনড় কিন্তু অবিবেচক অবস্থান তাকে একেবারে অন্য মানুষ হয়ে উঠতে বাধ্য করলো যেন। কোনোদিন যা করেননি, কোনো সময়ে যা তাকে দিয়ে হয়নি এবং যা করার কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না, তা-ই করে বসলেন। মাথায় অসম্ভব রাগ চেপে রেখে তাকে বললেন, 'আপনি জানেন আপনি কার এলাকায় এসে কথা বলছেন?
‘আপনের এলাকা? তো হইছে কী? আপনে আমারে মাইরবেন?'
‘মারবো তো অবশ্যই না, কিন্তু মানুষ যে আপনাদের গায়ে হাত তোলে, তা মনে হয় মাঝে মাঝে ঠিক-ই আছে। আপনাদের গোয়ার্তুমির কারণে আপনারা মার খান। ‘এত কথা কইয়েন না মামা। টেহা দেন, যাইগা।
তার সাথে বেশিদূর কথা আগানোর অবস্থায় তিনি ছিলেন না আর। রাগে গজগজ করতে করতে, টাকা ক’টা গুনে একপ্রকার তাচ্ছিল্যের সাথে তার হাতে দিয়ে সোজা রাস্তা ধরলেন; কিন্তু তার রাগ, তার অহংকার আর দম্ভোক্তি বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না। হোক রাগের মাথায়, হোক রিকশাওয়ালা-ই ভুল কিংবা অন্যায় করেছে, কিন্তু যে অন্যায় তিনি রিকশাওয়ালার সাথে করে ফেলেছেন, যে কদর্য ব্যবহার, যে অশালীন আচরণ তিনি প্রদর্শন করেছেন খানিক আগে, তা যখন পুনরায় তার মানসপটে ভেসে উঠলো, তিনি যেন ভেতর থেকে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যেতে লাগলেন! যেন তিনি ভেঙে যেতে লাগলেন হুড়মুড় করে। একটু আগে যে রূপ তিনি দেখিয়েছেন, যে ভাষা মুখ দিয়ে বের করেছেন, তা কোনোভাবেই তার পরিচিত নয়। এই ‘তিনি’কে তিনি চেনেন না।
রিকশাওয়ালা তাকে যে জায়গায় নামিয়ে দিয়ে ভাড়া গুনে নিয়ে ফিরে গেছে, সেখান থেকে হেঁটে বাসায় যেতে তার বড়োজোর চার থেকে পাঁচ মিনিট লাগে। ওই চার/ পাঁচ মিনিট সময় ব্যয় করে বাসায় ফেরার আগেই তিনি বিবেকের দংশনে পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে লাগলেন। বারবার তার মনে হচ্ছিলো, ‘হায় আল্লাহ! এ আমি কী করে ফেললাম?? আল্লাহর দরবারে বারংবার ক্ষমাপ্রার্থনা করেই চললেন তিনি। গরিব একজন মানুষের সাথে তার এমন কদর্য ব্যবহারের কারণে, এমন অশালীন আচরণের কারণে মালিক যেন তার প্রতি অসন্তুষ্ট না হন, সেজন্য তার চিন্তার জগতে, তার মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে কেবল একটাই ব্যাপার ঘটে চলেছে। তখন—ইস্তিগফার। আল্লাহর কাছে বারে বারে মাফ চাওয়া।
দুই.
ইমাম ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন বান্দা পর্বত পরিমাণ ভালো আমল নিয়ে হাজির হবে, কিন্তু সে দেখবে—কেবল কদর্য ভাষার কারণে তার সমস্ত ভালো আমল ভেস্তে গেছে। (আদ-দাউ ওয়াদ-দাওয়া : ১৮৮)
সারাজীবনের চেষ্টায় যেটুকু আমল নিয়ে মহামহিম রবের দরবারে হাজির হতে হবে, যা কিছু সঞ্চয় ওপারের জন্য জমা আছে, কেবল রিকশাওয়ালার সাথে এমন অমানবিক আচরণের কারণেই যদি সব হারাতে হয়, তাহলে এর চাইতে বড় দেউলিয়াত্ব আর কী আছে?
কারো কারো মনে হতে পারে, কী এমন আহামরি রিকশাওয়ালাকে বলে ফেলেছেন, যার দরুন তিনি এভাবে ছটফট শুরু করেছেন? হতে পারে আহামরি কিছুই তিনি বলেননি। হতে পারে সাধারণ বাঙালি মুসলিম, তার রোজকার জীবনে শ্রমিক শ্রেণি আর নিম্নশ্রেণির মানুষের সাথে যে ভাষায় কথা বলে, তার চাইতেও অধিক সভ্য-ভব্য তার শব্দচয়ন, বাক্যের মাত্রা। রিকশাওয়ালাকে তিনি না চড় লাগিয়েছেন, না থাপড়ানোর হুমকি দিয়েছেন। এসবের ধারে-কাছেও ঘেঁষেননি তিনি। তথাপি কেন তার ভেতর এত অনুতাপ, অনুশোচনা?
মানুষ হয়তো-বা তার কথাগুলোতে তেমন কোনো শ্লেষ, তেমন কোনো তিরস্কার খুঁজে পাবে না; কিন্তু উচ্চারণের সময় তাতে কী পরিমাণ অহংকার, দাম্ভিকতা আর বড়োত্ব জাহিরের প্রয়াস ছিলো, তা কেবল তিনিই জানেন। আর একজন সাধারণ অশিক্ষিত মানুষ, যিনি নিতান্তই সংগ্রাম করে জীবনযাপন করেন, তার সামনে নিজের এহেন দাম্ভিকতা প্রদর্শন, অহংকারের এমন পসরা সাজানোর ফলে আল্লাহর দরবারে কোন কৈফিয়ত নিয়ে তিনি হাজির হবেন? হাজারো পাপের ভিড়ে আপাতদৃষ্টিতে ‘পাপ নয়’ এমন বিষয়টাও যদি তাকে পাকড়াও করার জন্য কিয়ামতের ময়দানে হাজির হয়ে পড়ে, কোন সে পথ, যা দিয়ে তিনি পলায়ন করবেন সেদিন? এই বোধটাই তাকে অনুতপ্ত করে তুলেছিলো সেদিন। ওই রিকশাওয়ালার কাছে মাফ চাওয়ার সুযোগটা তার হাতে ছিলো না, কিন্তু গাফুরুর রাহিম, যিনি জানেন বান্দার অন্তরের অবস্থা, তার কাছে অনুনয় করে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি বুঝলেন যে, তার ভুল হয়েছে। ভুল হয়ে গেলে ভুলের ওপর স্থির না থেকে, যুক্তি-তর্ক সাজিয়ে সেই ভুলকে সমর্থন করে অন্তরে প্রবোধ লাভের চাইতে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে নিজেকে শুধরে নেওয়ার মধ্যেই প্রভূত কল্যাণ।
ভুল হয়ে গেলে হোক সে ভুল একেবারে সামান্য কিংবা অণু পারমাণ, তবু তার জন্য আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত হতে পারা, ক্ষমা লাভের আশায় অশ্রু বিসর্জন করতে পারা, মুনাজাতে দুহাত উত্তোলন করতে পারা একটা সবুজ সতেজ হৃদয়ের স্বাক্ষর বহন করে। যারা ছোটোখাটো ভুলে একেবারে নত হয়ে যায়, অন্তর্দহনে অস্থির হয়ে পড়ে, তাদের দ্বারা বড় কোনো ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব সামান্য। তারা পথ হারায় কম। পদস্খলনের ব্যাপারে তারা সম্যক সতর্ক।
আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, একজন তাকওয়াবান পাপ কাজকে এমন ভয় পায়, সে মনে করে সে কোনো পাহাড়ের গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে, আর পাহাড়টা তার ওপর বুঝি ধ্বসে পড়তে যাচ্ছে। অপরদিকে পাপে নিমজ্জিত ব্যক্তি পাপ কাজকে এতই হালকাভাবে দেখতে শুরু করে, পাপ কাজ করাকে সে নাকের ডগায় থাকা একটা মাছির মতো মনে করে, যেন একটু হাত নাড়লেই তা উড়ে পালাবে।' (সহিহুল বুখারি : ৬৩০৮; মিশকাতুল মাসাবিহ : ২৩৫৮, শুআবুল ঈমান : ৬৭০২-হাদিসটির সনদ সহিহ)
আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু যে উপমা এখানে দিয়েছেন, তা খুবই যথাযথ। একজন তাকওয়াবান ব্যক্তি, যার হৃদয়ে সবসময় আল্লাহর ভয় কাজ করে, তার কাছে পাপ কাজকে পর্বত পরিমাণ বোঝা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ তার নফস এটার সাথে কোনোভাবেই অভ্যস্ত না। মিথ্যে কথা বলার আগে তার মন। দুরুদুরু করতে থাকে। ‘হায়! আমি কীভাবে মিথ্যে বলবো'—এমন মর্মযাতনায় সে বিধ্বস্ত হতে থাকে বারবার। কাউকে ঠকিয়ে কোনোকিছু অর্জনের মতন পাপ কাজ সামনে এলে সে শিউরে ওঠে। জীবনের এমন জটিল সমীকরণ থেকে সে পালিয়ে বাঁচতে চায়। কারণ সে জানে—জগতের আর কেউ জানুক বা না-জানুক, আম কেউ দেখক কিংবা না-দেখুক, আসমানে যিনি আছেন, যিনি মানুষের অন্তঃকরণ থেকে শুরু করে গভীর পাতালে থাকা অণুজীবের ব্যাপারেও ওয়াকিবহাল, তার চোখকে ফাঁকি দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। হাশরের ময়দানে যখন আমলনামা হাজির করা হবে, সেদিন আজকের এই খুচরো মিথ্যে যা একান্ত হাসতে হাসতেই, কৌতুকাচ্ছলেই বলে ফেলা হলো, আজকের এই লোক ঠকানি, যা কেউ দেখেনি। ভেবে সেরে ফেলা হলো নির্বিঘ্নে, সবকিছুই যে একে একে সামনে তুলে ধরা হবে সে ব্যাপারে তাকওয়াবান ব্যক্তি মাত্রই সবিশেষ জ্ঞাত। তাই জীবনের যেকোনো অনুষঙ্গে, যেকোনো পাপ কাজের সুযোগে সে শিউরে ওঠে, পালায় আর ভাবে, ‘এই বুঝি আযাবের পর্বত ধ্বসে পড়লো আমার মাথায়। (ফাতহুল বারি, খণ্ড : ১; পৃষ্ঠা: ১০৩-১০৪)
অন্যদিকে যার অন্তঃকরণে নেই আল্লাহর ভয়, যার কাছে আখিরাত কেবল কেতাবি আলোচনার বিষয়বস্তু, পাপ কাজকে সে খুব সস্তাভাবেই দেখে; এমন সস্তা ভাবে যে, আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জুতসই উপমার মাধ্যমেই বলেছেন সেটা—যেন নাকের ডগায় বসা কোনো মাছি, হাত নাড়ালেই উড়ে চলে যাবে।
এ হলো আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল আর আল্লাহকে স্মরণকারী দুটো হৃদয়ের উদাহরণ। কোন শিবিরে আমরা নিজেদের দেখতে পছন্দ করি, তা বেছে নেওয়ার দায়িত্ব নিজেদের। সেই শিবিরে, যে শিবিরে সদা-স্মরণে গুঞ্জরিত হয় মহামহিমের নাম? নাকি সে শিবিরে, যাদের অন্তঃকরণে পড়ে গেছে অবাধ্যতার মরিচা?
তিন.
ভুল করার পরে যদি আপনি ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হন, অনুতপ্ত হন, যদি অনুশোচনায় কাতর হয়ে ওঠে আপনার তনুমন, তাহলে জানুন— আপনার অন্তরের কোথাও এখনো জিইয়ে আছে এক টুকরো সবুজ। সেই সবুজটাকে বাড়তে দিলে তা নিশ্চিতভাবে একদিন ঘন অরণ্যে পরিণত হবে। তাতে যদি পানি দেওয়া হয়, পরিমিত পরিচর্যা করা হয়, একদিন সেই অরণ্যের বনে বসবে মহীরুহের মেলা।
ভুল করার পরে ‘আল্লাহর সামনে কীভাবে দাঁড়াবো'—এই ভয়ে যদি প্রকম্পিত হয় আপনার অন্তর, তাহলে নিশ্চিত হন—আপনার হৃদয়ের কোথাও এখনো মিটিমিটি করে জ্বলছে একটুকরো আলো। আলোটাকে নিভতে না দিয়ে যদি আরো ভালোভাবে জ্বলে ওঠার বন্দোবস্ত করা যায়, তাহলে অন্ধকার হৃদয় একদিন আলো ঝলমলে উঠোনে পরিণত হবে।
মানুষ-ই ভুল করে এবং মানুষকেই ভুল শুধরানোর, ভুল থেকে ফিরে আসার, তাওবা করার সুযোগ দেওয়া হয়। মানুষকে মূলত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'তোমরা যদি কোনো পাপ না করতে, তাহলে আল্লাহ অন্য কাউকে তোমাদের জায়গায়। স্থলাভিষিক্ত করতেন। তারা পাপ করতো আর মাফ চাইতো, এবং তাদেরকে মাফও করা হতো।'(সহিহ মুসলিম : ২৪৭৯)
মানুষকে এই কাঠামোতেই তৈরি করা হয়েছে। বান্দা পাপ করবে, ভুল করবে এবং অবাধ্য হবে; তবে দিনশেষে সে প্রত্যাবর্তন করবে তার রবের কাছে। নিজের যাবতীয় কৃতকর্মের জন্য সে হবে অনুতপ্ত। অনুশোচনায় কাতর হয়ে উঠবে তার হৃদয়-মন। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে ক্ষমা ভিক্ষা চাইবে। যে পাপ থেকে সে ফিরে আসবে, তার নিকটবর্তী না হওয়ার এক কঠিন সংকল্প নিজের ভেতর রাখতে হবে।
শাইখ আলি তানতাবি রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘একবার আমার জানতে ইচ্ছে হলে, আল্লাহ কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসেন? আগ্রহ ও কৌতূহলের জায়গা থেকে আমি এর উত্তর পেতে চাইলাম কুরআন থেকে। কুরআন খুলে দেখতে লাগলাম যে, আল্লাহ কাদের ভালোবাসেন? কী তাদের বৈশিষ্ট্য?
আমি কুরআন খুলে দেখলাম, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নেককারদের ভালোবাসেন। ভাবলাম, ‘আমি কি নেককার বান্দা?' মনে হলো, না। তাহলে তো আমি এই তালিকা থেকে বাদ পড়লাম।
তারপর দেখলাম, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন; কিন্তু নিজেকে খুব। ধৈর্যশীল বলে মনে হলো না আমার। ফলে এই তালিকা থেকেও বাদ পড়ে গেলাম। বেশি এরপর দেখলাম, আল্লাহ মুজাহিদদের ভালোবাসেন, যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে; কিন্তু আমার মতন অলস আর অক্ষম ব্যক্তি তো এই তালিকায় ওঠার কথা ভাবতেও পারি না। ফলে এখান থেকেও ছিটকে গেলাম।
-তারপর দেখলাম, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, যারা সৎ কাজে এগিয়ে; কিন্তু নিজের আমল আর আখলাকের দৈন্যদশা দেখে এই তালিকাতেও নিজেকে ভাবা গেলো না।
একপ্রকার হতাশা আর গ্লানিবোধ নিয়েই আমি কুরআন বন্ধ করে ফেলি। নিজের আমল, তাকওয়া আর ইখলাসের দিকে তাকিয়ে আমি তাতে রাজ্যের ভুল-ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পেলাম না। কিন্তু একটু পরেই আমার মনে হলো, 'হ্যাঁ, আল্লাহ তো তাদেরও ভালোবাসেন যারা তাওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে।'
মনে হলো, এই একটা বৈশিষ্ট্যই বুঝি আমার জন্য মজুদ আছে এবং আমি তা যখন-তখন নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারি। এরপর আমি খুব বেশি পরিমাণে ইস্তিগফার পড়তে থাকি, যাতে করে আমি আল্লাহর সেসব বান্দাদের তালিকাভুক্ত হতে পারি, যারা অধিক পরিমাণে তাওবা করে এবং যাদের আল্লাহ ভালোও বাসেন।(সুরা বাকারা, আয়াত : ২২২)
আমরা হয়তো-বা নেককার হতে পারলাম না, আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদ হওয়ার সৌভাগ্যও হয়তো আমাদের কপালে নেই। অনুপম ধৈর্য্যের অধিকারী কিংবা যারা বেশি ভালো কাজে অগ্রগামী—তাদের দলভুক্তও হয়তো হতে পারলাম না; কিন্তু তাই বলে কি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ভালোবাসার তালিকা থেকে একেবারে বাদ পড়ে যাবো? কখনোই নয়। আল্লাহর প্রিয়ভাজন হওয়ার একটা রাস্তা সদা-সর্বদা খোলা রয়েছে আমাদের জন্য। আর সেই রাস্তা হলো—তাওবার রাস্তা। অধিক পরিমাণে তাওবা করা। আল্লাহর কাছে নিজের পাপ, নিজের ভুল, নিজের অবাধ্যতার জন্য কায়মনোবাক্যে ক্ষমা চাওয়া।
ভুল করেও ভুলের ওপর স্থির থাকা এবং সেই ভুলকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে জায়েয বানানোর চেষ্টা করাটা শয়তানের বৈশিষ্ট্য। আদম আলাইহিস সালামকে সিজদা করতে অস্বীকার করাটা ছিলো ইবলিসের ভুল আর সেই ভুলকে—‘আমি আগুনের তৈরি আর আদম মাটির তৈরি, তাই আমি সেরা হয়ে কেন আদমকে সিজদা করবো’—যখন সে স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণে লেগে গেলো, তখন সে ভুলের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো একেবারেই। এই মাত্রা ছাড়ানোটাই তাকে অভিশপ্ত বানিয়ে ছাড়লো।
অপরদিকে ভুল করার পর তা বুঝতে পারা, তার জন্য অনুতপ্ত হওয়া, তা থেকে বিরত হওয়া এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া একটা সতেজ, সুন্দর এবং সবুজ অন্তরের প্রমাণ বহন করে। জান্নাতে শয়তানের প্ররোচনায় নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ার কারণে যখন আদম আলাইহিস সালাম এবং হাওয়া আলাইহাস সালামকে দুনিয়ায় নামিয়ে দেওয়া হয়, তখন তারা নিজেদের কৃত ভুল বুঝতে পেরে, তার জন্য অনুতপ্ত হয়ে, গভীর অনুশোচনাসহ তারা আল্লাহর কাছে করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করেন। ভুল হয়ে গেলে তা নিয়ে অন্তরে পেরেশানি দেখা দেওয়াটা তাকওয়ার লক্ষণ।
তাই, কখনো ভুল হলে, কখনো পাপ কাজ হয়ে গেলে—হোক তা যত ক্ষুদ্র আর নামমাত্র, তা থেকে ফিরে আসার তাগাদা হৃদয়ে মজুত রাখতে হবে। ভুলের ওপর অটল না থেকে, তা থেকে বিরত হয়ে, নফল সালাতে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে ক্ষমা চাইতে পারলে অন্তর প্রশান্ত হয়। বারে বারে সেই ভুলের কথা স্মরণ করে অনুতপ্ত হওয়া, তার জন্য বারে বারে আল্লাহর ক্ষমা আশা করে ইস্তিগফার পাঠ করা এবং নিজের পাপ মোচনের নিমিত্তে কিছু দান-সাদাকা করতে পারলে একদিকে যেমন আল্লাহর নৈকট্য লাভে এগিয়ে যাওয়া যায়, অন্যদিকে ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে ধারণ করা যায় ভালো কিছু আমলের চর্চা।